জগৎ মুক্তিতে ভোলালে সাঁই
ভক্তি দাওহে যাতে চরণ পাই ॥
রাঙ্গা চরণ দেখব বলে
বাঞ্ছা সদায় হৃদ কমলে
তোমার নামের মিঠাই মন মজেছে
রূপ কেমন তাই দেখতে চাই ॥
ভক্তিপদ বঞ্চিত করে
মুক্তিপদ দিচ্ছ তারে
যাতে জীব ব্রহ্মাণ্ডে ঘোরে
কান্ড তোমার দেখি তাই ॥
চরণের যোগ্য মন নয়।
তথাপি মন ওই চরণ চাই
অধীন লালন বলে হে দয়াময়
দয়া কর আজ আমায় ॥

ফকির লালন শাহ্ ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি সুফি সাধক, বাউল গানের অগ্রদূত, দার্শনিক এবং সমাজসংস্কারক। তিনি ১৮শ শতকের শেষদিকে এবং ১৯শ শতকের প্রথমভাগে জীবিত ছিলেন। তাঁর জীবন সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া কঠিন, কারণ তিনি নিজেই তাঁর জন্ম ও জাতিগত পরিচয়কে গৌণ করে দেখেছেন। তবে গবেষকরা ধারণা করেন, তাঁর জন্ম ১৭৭৪ সালের আশেপাশে, এবং মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর।
জন্ম ও শৈশব:
লালনের জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন তিনি কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়াতে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ বলেন তিনি ছিলেন একজন হিন্দু বংশোদ্ভূত, পরবর্তীতে অসুস্থ অবস্থায় মুসলিম এক পরিবারে আশ্রয় পেয়ে সুফি ধারার প্রভাবে বাউল দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি নিজের পরিচয় মুছে দিয়ে মানবতাকেই মুখ্য মনে করতেন।
দর্শন ও চিন্তাধারা:
লালন শাহ্ মানুষে মানুষে বিভেদে বিশ্বাস করতেন না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ—সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে তিনি বলতেন,
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”
তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তার গান ও দর্শনে এক ধরণের সহজিয়া ভাব আছে, যেখানে আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতা একত্র হয়েছে।
সঙ্গীত ও অবদান:
লালন অসংখ্য গান রচনা করেছেন, তবে তিনি নিজে তা লিখে রাখেননি। তাঁর শিষ্যরা মুখে মুখে তা সংরক্ষণ করেছে। তাঁর গানগুলোতে জীবন, মৃত্যু, আত্মা, ঈশ্বর, সমাজবিচার, প্রেম ইত্যাদি বিষয় ফুটে উঠেছে। কিছু বিখ্যাত গান হলো:
- “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়?”
- “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?”
- “মিলন হবে কতো দিনে”
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার:
১৮৯০ সালে লালন শাহ্ মারা যান। তাঁর সমাধি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে অবস্থিত, যেখানে প্রতিবছর লালন মেলা হয়—হাজারো বাউল ও সাধক এই মেলায় অংশ নেন।
লালনের ভাবধারা ও গান শুধু বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের দার্শনিক চেতনাতেও এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে।