উকিল মুনশি একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। তবে বাউলগানের আসর বসলেই একতারা হাতে সেখানে ছুটে যেতেন। অক্ষরের পিঠে অক্ষর বসিয়ে তৈরি করতেন গান। সেই গানে সুর দিতেন। তাঁর গান, তাঁর সুরে আবিষ্টতা তৈরি হতো। চমৎকার ছিল তাঁর গানের গলা। সেই গলায় উপচে পড়ত বিচ্ছেদ। সে কারণেই বোধহয় তাঁকে বলা হতো ‘বিরহী উকিল’। আবার ঠিক কী কারণে বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম তাঁকে ‘ভাবের সাগর’ বলতেন সেটাও অনুসন্ধানের বিষয়। বাউল মতবাদের রীতিনীতি, শরিয়ত-মারিফত ভেদ-বিচার, সৃষ্টিতত্ত্ব ও দেহতত্ত্ব নিয়ে উকিলের ব্যাপক পাণ্ডিত্যই মনে হয় এই ‘ভাবের সাগর’-এ অভিষিক্ত করার মূল কারণ।

বাউলশাস্ত্রের নিগূঢ়তত্ত্বধর্মী গানের চেয়ে উকিলের বিচ্ছেদ গানের পরিমাণই বেশি। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বোঝায়—তাঁর প্রায় নিরানব্বই ভাগ গানই বিচ্ছেদ পর্যায়ভুক্ত। এসব গানে প্রচ্ছন্নভাবে বাউল-দর্শন যে একেবারেই পরিস্ফুট হয়নি, তাও কিন্তু বলা যাবে না। তবে সেসব ছাপিয়ে তাঁর গানের বিরহী-সত্তাই ঝলঝল করে দাপিয়ে বেড়ায় পাঠক/শ্রোতাদের মনে।

উকিল মুনশির বেড়ে ওঠা যেমন শোক-দুঃখের মধ্য দিয়ে তেমনি জীবনভর নানা ঘাত-প্রতিঘাত-প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে পথ চলতে হয়েছে। দশ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু, মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে, প্রেমের বিয়ের কারণে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি, ছোটো ভাই ও প্রিয়তমা স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু থেকে শুরু করে তাঁর শেষ বয়সে ছেলে আবদুস সাত্তারের মৃত্যু—তাঁর পুরো জীবনটাই যেন বিষাদগাথা। সম্ভবত এসব কারণেই উকিলের পুরো সত্তায় বিরহ ভর করেছিল ব্যাপকভাবে। তাই তিনি বাউল-মতবাদে বিশ্বাসী হয়েও তত্ত্বগানের চেয়ে বিচ্ছেদ গান রচনাতেই বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন।

উকিল মুনশির বিচরণক্ষেত্র ছিল নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ পুরো হাওরাঞ্চল। তাঁর সুললিত কণ্ঠের বিচ্ছেদ শোনার জন্য রাতের পর রাত জেগে থাকত হাওরের মানুষ। উকিলের গানের আসরের খবর মুখে-মুখে ছড়িয়ে যেত এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম। গ্রামের যে উঠোনে আসর বসত সেখানে তিল- ধারণের ঠাঁই থাকত না। লোকে লোকারণ্য হতো উকিলের গান শোনার সম্মোহনী আকর্ষণে। গান গাইতে-গাইতে কাঁদতেন এবং দর্শক- শ্রোতাদেরও কাঁদাতেন। উকিলের গানের এমনই বুননশৈলী আর মায়াবী টান, যা শোনামাত্র শ্রোতাদের বিষাদগ্রস্ত হওয়াটা ছিল অনিবার্য।

বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক কাঠামোর মূল ভিত্তি শত-সহস্ৰ নদ-নদী- খাল-বিল। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব জলাধার সুতোর মতো পেঁচিয়ে রেখেছে পুরো দেশকে। এরও বাইরে দেশের সাতটি জেলার বিস্তৃত রয়েছে অসংখ্য হাওর। যে অঞ্চলের বাসিন্দারা ছয় মাস পানিবন্দী থাকেন। এ ছয়মাস হাওরের অবারিত পানির উতরোলে মানুষের ভাসমান জীবন পানির ঢেউয়ের মতন কখনো অশান্ত, দুর্বার—আবার কখনো শান্ত। সেই জনপদেই জন্ম নিয়েছিলেন উকিল মুনশি।

নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরি উপজেলার নুরপুর বোয়ালী নামক যে গ্রামটিতে উকিলের জন্ম, বর্ষায় সেই গ্রাম কাঁপিয়ে দেয় হাওরের ঢেউ। পানির সঙ্গে নিত্য যুদ্ধ করেই বেঁচেবর্তে থাকেন গ্রামের বাসিন্দারা। শুকনো মৌসুমে সেই বাসিন্দারাই কাকডাকা ভোরে লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেন ধানী-জমির দিকে। সংগ্রামমুখর জীবনের এসব দৃশ্য দেখতে-দেখতেই বড়ো হয়েছে উকিল। মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করেছেন এবং সেখান থেকে জুগিয়েছেন গানের রসদ। হাওরবাসীর বেদনাবিদুর জীবনের নির্যাসটুকুই তাঁর গানের প্রাণ, তাঁর গানের ভিন্নতা।

উকিল মুনশির গানের উৎসভূমি মূলত হাওর। সেখানকার মনোলোভা প্রাকৃতিক দৃশ্য যে-কাউকেই শিল্পী-বাউল করে তোলে। বিশ শতকের বাউল উকিল সেই ধারাবাহিকতারই ফসল। তত্ত্ববাণীনির্ভর কোনো পদবালি নয় বরং হাওরের লিলুয়া বাতাসের মতন যেন পরশ বুলিয়ে যায় উকিলের গান। কখনো উত্তাল কখনো শান্ত—হাওরের পানির গতির এই যে প্রকৃতিজ সুর, সেটিই উকিল আজীবন ধারণ করে জীবনঘনিষ্ঠভাবে ভাটির মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন।

উকিলের গানে প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ের আর্তি প্রাধান্য পেয়েছে। সতত চঞ্চল মানব-মনের প্রেম-ভালোবাসা-বেদনাবোধ নবমাত্ৰা পেয়েছে তাঁর গানের পঙ্ক্তিতে, তাঁর সুরে। প্রেমিকবিহীন ঘরে বন্দী ‘অভাগিনী’ তাঁর গানের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এ ‘অভাগিনী’-র মুখেই বিধৃত করেছেন বিরহের অসংখ্য পঙ্ক্তিমালা। হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশির সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা প্রতীক ও উপমা অবধারিতভাবেই তাঁর গানে বারেবার স্থান পেয়েছে। মূলত এসব অনুষঙ্গ ঘিরেই উকিল মুনশির গানের বিচিত্র ভুবনের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

হাওরাঞ্চলে উকিল মুনশির দরাজ কণ্ঠের সুরমাধুর্যের বর্ণনা সর্বজনবিদিত। তাঁর সম্পর্কে আলোচনা চললে একইভাবে তাঁর ছেলে আবদুস সাত্তারের অসাধারণ গায়ন-ভঙ্গির প্রসঙ্গও উঠে আসে। বাবা- ছেলের বিচ্ছেদী সুর ছাড়াও মালজোড়া গানের প্রসিদ্ধ শিল্পী হিসেবেও তাঁদের ব্যাপক নাম-যশ ছিল। উকিল ঘাটুগানের মধ্য দিয়ে গানের জগতে প্রবেশ করে শেষ বয়সে বাউলগানের প্রখ্যাত শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন। উকিলের দেহবসান হয়েছে সেই কবে কিন্তু তাঁর বিপুল সৃষ্টি নিয়ে শ্রোতাদের আগ্রহ ক্রমশই বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর বিচ্ছেদ পর্যায়ের গানগুলো তরুণ-প্রজন্ম লুফে নিয়েছে। প্রিয়তমের প্রতি প্রবল আবেগ ও ভালোবাসাই এসব গানের প্রাণ।

গ্রামীণ মানুষেরা যেভাবে কথা বলেন সে-রকমই সহজ-সরল ভাষায় উকিল মুনশির গানের কাঠামো তৈরি হয়েছে। নির্মেদ এসব গান তাই অতি সহজেই ছুঁয়ে গেছে গ্রামীণ সাধারণ মানুষদের। এর ফলে বিচ্ছেদ গানের জগতে তিনি অর্জন করেছেন অনন্য বিশিষ্টতা।

উকিল মুনশির বিচ্ছেদ পর্যায়ের গানগুলোতে এক ধরনের হাহাকার ও বেদনা লুকিয়ে রয়েছে। নববধূ কিংবা প্রেমে-পড়া কিশোরীর হৃদয়ে তোলপাড় করা বিরহই প্রায় গানের মুখ্য উপাদান। তাঁর গানের কাহিনির উৎসভূমি হাওরাঞ্চল। সঙ্গত কারণেই ‘নুয়া পানি’, ‘আফাল’, ‘উজান-ভাটি’, ‘লিলুয়া বাও’, ‘ভাসা পানি’, ‘সুজন মাঝি’, ‘নাইওরি’, ‘নাও’-সহ হাওরাঞ্চলের চিরপরিচিত এসব শব্দবন্ধ তাঁর গানে অহরহ এসেছে।

উকিল বিচ্ছেদ রচনায় যেমন মুনশিয়ানার ছাপ রেখেছেন তেমনি গায়কীতেও ছিলেন অনন্য। তাঁর গলায় বিচ্ছেদ গান দারুণ মানাতো বলে অনেকেই উল্লেখ করে থাকেন। সম্ভবত এ কারণেই উকিল মুনশি নামের চেয়েও ‘বিরহী উকিল’ অভিধাটিই হাওরবাসীর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। উকিলও তাঁর একাধিক গানের ভণিতায় ‘বিরহী উকিল’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর এসব বিচ্ছেদ গানের রচনাশৈলীর অভিনবতা ও নতুনত্ব সাধারণ মানুষের আবেগে নাড়া দিয়েছে। এর ফলে তিনি জীবদ্দশায়ই শ্রোতাদের কাছে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

বিচ্ছেদ গানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও উকিল মুনশির নিগূঢ়তত্ত্ব-নির্ভর বেশকিছু গান রয়েছে। এছাড়া মুর্শিদ-বন্দনা, নবি-রাসুলতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব এবং কামতত্ত্ব পর্যায়েরও গান রয়েছে। তাঁর রচিত এসব গান খুব একটা প্রচার-মাধ্যমের আলোয় না-এলেও নেত্রকোনা অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বাউলগান-চর্চাকারীদের মধ্যে ঠিকই দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত হয়ে আসছে। মুর্শিদ-বন্দনাসূচক নিম্নোক্ত গানটি তো বহুল প্রচলিত

মুর্শিদ নামে সারি গাইয়া দিয়াছি সাঁতার
পার করো ডুবাইয়া মারো ভরসা তোমার।
মুর্শিদ আমার পারের কর্ণধার
মুর্শিদ নাম ভরসা করে দিয়াছি সাঁতার
আমি যদি ডুবে মরি কলঙ্ক তোমার।
মুর্শিদ আমার জীবনের জীবন
মুর্শিদ আমার নয়নমণি অমূল্য রতন
তুমি বিনে এ সংসারে কে আছে আমার।
দীনহীন কাঙাল উকিলে বলে
মুর্শিদ তোমার চরণতলে রাখিও মোরে
ইহ-পরকালে মোরে করিও উদ্ধার।  

মুর্শিদের প্রতি নিবেদন/আসক্তি বাউল-ফকিরি সাধনায় চিরায়ত মতবাদ। একজন বাউল মাত্রই তাঁর মুর্শিদ/গুরুর প্রতি চরমভাবে নির্ভরশীল। এসব সম্প্রদায়ভুক্ত সাধকেরা বিশ্বাস করেন, মুর্শিদ ছাড়া ‘ভবসাগর’-রূপী এই জগত-ব্ৰহ্মাণ্ড থেকে মুক্তি পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একই ধারাবাহিকতায় পূর্বসূরি সাধকদের মতোই উকিলের গভীর আর্তি—’মুর্শিদ তোমার চরণতলে রাখিও মোরে/ইহ-পরকালে মোরে করিও উদ্ধার’।

উকিল মুনশি জানেন—কামরূপী যে ‘খাড়া নদী’ সেখানে উজানে তরি বাইতে হলে মুর্শিদবাণীকে সত্যসার মেনে অগ্রসর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। নতুবা এ আফসোসই জীবনভর থাকবে—’আমি কেমনে দিব পাড়ি/এখন আমি উপায় কী করি।/একে আমার ভাঙা তরি পাপেতে বোঝাই/বেলা গেল সন্ধ্যা হলো দেশে কেমনে যাই’। উকিল এও জানাচ্ছেন, কামনদী পাড়ি দেওয়ার জন্য ‘মদনাচোরা’-কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ এই ‘মদনাচোরা’ই অনবরত ‘কামবাণ’ নিক্ষেপ করতে থাকে। সে বাণ থেকে ‘হিসাব-নিকাশ, পুঞ্জি-পাট্টা’ ঠিক রাখার জন্য শিষ্যের প্রতি মুর্শিদের সতর্ক-বার্তা—’রূপের ঘরে কুম্ভীর থাকে/ভক্ষণ করে যদি কুম্ভীরি দেখে রে/মারে মানুষ লাখে লাখে/না জানলে তাহার সন্ধান’।

কামকুম্ভীরের সন্ধান জানার জন্য গুরুর বাক্য অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলতে হয়। তবেই সাধন-সিদ্ধি চূড়ান্ত রূপ পাবে। সামান্য ভুলে ‘বস্তু’ ক্ষয় হলে মায়াময় জগত-সংসারের বন্ধন-মুক্ত কখনোই হওয়া সম্ভব হয় না। কারণ ‘বস্তু’ ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নতুন প্রাণের জন্ম নেয়। সেই প্রাণের প্রতি সাধকের এক ধরনের মায়া-মোহ তৈরি হয়। সেই মোহ থেকে জন্ম নেয় জাগতিক লোভ-লালসা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিসহ নানা বিষয়াদি। একসময় এসব বিষয় সাধনার চেয়েও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এভাবে সাধক তাঁর সাধন-পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হন।

সাধন-পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত না-হতে চাইলে ‘কামনদী’-র জোয়ার থেকে দেহরূপী তরিকে নির্বিঘ্নে পাড়ি দিতে হয়। এই পাড়ি দেওয়াটাও কিন্তু আয়াসসাধ্য ব্যাপার নয়। এরজন্য সাধনকারীকে পলে-পলে বিপদের মুখোমুখি হয়েও টিকে থাকতে হয়। এ নিয়ে উকিলের সাবধান-বাণী :

কাম নদীতে হুঁশে বাইও তরি
ধার চিনিয়া সাঁতার দিলে
ঘটবে না বিপদ ভারি।
যখন নদীর জোয়ার ওঠে
ঢেউ গিয়া আকাশে ওঠে
কত নদ-নদী জলে ভাসে
ডুবায় কত ঘরবাড়ি।
একটি নদীর তিনটি সুতা
আছে তিন গাঙের মাথা
তিন সুতাতে হরফ তিনটা
আলিফ লাম মীম যোগ করি।
বিরহী উকিলের ইচ্ছামতে
কামনদীতে বাইতে বাইতে গা
দেহেতে ধইরাছে রোগে
ঠিক নাই কোন দিন যাই মরি।

উপর্যুক্ত তত্ত্ববহুল গানের পাশাপাশি উকিল মুনশি দেহতত্ত্বের বেশকিছু গান রচনা করেছেন, যদিও সেগুলো অনেকটাই তাঁর পূর্বসূরি সাধকদের অনুকরণে রচিত। এরপরও উকিলের ভাষা-বর্ণনার সাবলীলতা ও সহজবোধ্যতা গানগুলোকে ভিন্নতা দিয়েছে। উকিল মুনশির বিচ্ছেদ পর্যায়ের গানের পাশাপাশি তাঁর তত্ত্বাশ্রিত বাউলাঙ্গিকের গানগুলোও একদিন অমরতা পাবে—এ প্রত্যাশা নিশ্চয় অমূলক কিছু নয়।

মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন-সংকলিত হারামণি-র ভূমিকায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘বাউল গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দুমুসলমানের কণ্ঠ মিলেচে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধে নি।’ সেটা বাউল-পরম্পরায় সব সাধকেরাই ধারণ করেছেন। উকিল মুনশিও সেই একই পথের পথিক।

উকিল মুনশি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পুরাণের বিষয়বস্তু নিয়ে গান রচনা করেছেন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে উপজীব্য করে প্রচুর গান রচনা করেছেন। উকিল নিজে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও (যদিও বাউলেরা প্রচলিত অর্থে ব্যবহৃত ধর্মকে অস্বীকার করে মানবধর্মে বিশ্বাসী) হিন্দু-মিথকে অবলম্বন করে গান রচনার বিষয়টি তাঁর উদার ও মুক্তমনের পরিচায়ক।

হিন্দু-পুরাণে বহুল আলোচিত রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়কাহিনি তাঁর গানের বিশাল অংশ জুড়ে বিধৃত হয়েছে। এর বাইরে নিমাই, শচীমাতাও তাঁর গানের অন্যতম পার্শ্ব-চরিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। তবে এসব গানের চরিত্রগুলোর বেদনার্ত-সময়ের করুণ ঘটনাগুলোই উকিল উপস্থাপন করেছেন। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক রচিত এসব বিচ্ছেদ গান তরুণ প্রজন্মের কাছে সাম্প্রতিক সময়ে অধিকমাত্রায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

কৃষ্ণ বিরহে রাধার প্রাণ যখন উতলা হয়ে চরম বিরহ-পর্যায়ে পৌঁছায় তখন উকিল মুনশির কণ্ঠে যেন বিরহিণী রাধার খেদোক্তি ঝরে : ‘কৃষ্ণপ্রেমে পোড়া দেহ কী দিয়া জুড়াব গো সখি/কে বুঝিবে অন্তরের বেদনা’। ‘ফুলশয্যা’ সাজিয়ে রাতের প্রহর কৃষ্ণের অপেক্ষায় নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়ার পরও যখন তাঁর দেখা মেলে না, তখন ‘অভাগিনী’ রাধা কৃষ্ণকে ধরে আনার জন্য ‘বৃন্দা দূতি’-কে পাঠান। পুরাণের এই চিরায়ত ঘটনার ‘বৃন্দা দূতি’ সেজে উকিল মুনশি শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে নিবেদন করেন :

শ্যাম বিচ্ছেদে প্রাণ বাঁচে না
মইল গো রাই কাঞ্চাসোনা।

ও কৃষ্ণ হে
মথুরাতে হইয়া রাজা
কুজার সনে ভালোবাসা
রাইয়ের কথা মনে ছিল না,
ও রাইয়ের সোনার অঙ্গ মলিন হলো
দেহেতে প্রাণ আছে কি না।

ও কৃষ্ণ হে
আমি রাইয়ের বৃন্দা দূতি
তোমায় নিতে আসিয়াছি
বলো কৃষ্ণ যাবে কি না,
আমি দেখে আইলাম দশম দশা
ডাকলে রাইয়ে কথা কয় না।

ও কৃষ্ণ হে
বৃন্দাবন বন হইয়াছে
যমুনার জল নীরব আছে
পখিগণে কথা বলে না,
উকিল মুনশি ধুলায় পড়ে
করতেছে সদায় রোদনা।

এ-রকম অসংখ্য গান রচনা করেছেন উকিল মুনশি। তবে এসব গানে একাকিনী ও বিরহিণী রাধার মনোকষ্ট, কৃষ্ণকে ভালোবেসে রাধার সংসার-জগতে কলংকিনী উপাধি পাওয়ার ঘটনা এবং কৃষ্ণের প্রেমের ছলনাই মূলবিষয়বস্তু হিসেবে স্থান পেয়েছে। হিন্দু পুরাণের ওপর নির্ভর করে উকিল গান রচনা করলেও তাঁর চিরায়ত বিচ্ছেদ সত্তার পরিপূর্ণ ছাপ এসব গানে সুন্দরভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে।

সুমনকুমার দাশ

তথ্যসূত্র
মাহবুব কবির (সম্পা.), উকিল মুন্সির গান (ঢাকা : ঐতিহ্য, ২০১৩)

Newsletter Subscribe

Get the Latest Posts & Articles in Your Email

We Promise Not to Send Spam:)