পড় ইবনে আব্দুল্লাহ ।
পড়লে যাবে জীবের
মনের ময়লা ॥

এক রাহু বিসমে রাব্বেকা
আছে ছুরা ত্রিশ পারা
নবীজী তা পড়ে না,
জীবরাইল তা শোনে না
মহর নবুয়ত দিলেন খোদাতালা ॥

হিরা পর্বত গুহাতে
বসেছিলেন দীনের নবী মোসাহেদাতে
সেথায় জীবরাইল হয়ে হাজির
খেলাফত দিলেন মালেক আল্লা ॥

নবীর পৃষ্ঠে মোহর নবুয়ত রয়
আশেকেতে আক্কাস দেখে
ভক্তগণ কে কয়,
লালন বলে এ ভেদ জানলে
যাবে মনের ত্রিতাপজ্বালা ॥

.

ফকির লালন শাহ্‌ (১৭৭৪ – ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বাংলার অন্যতম মহান মানবতাবাদী সাধক, দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার ও বাউল সম্প্রদায়ের প্রধান পথপ্রদর্শক। তিনি ছিলেন এমন এক লোকদার্শনিক, যিনি জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও সামাজিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকেই জীবনের মূল মন্ত্র হিসেবে প্রচার করেছেন। তাঁর জন্মস্থান ও পরিচয় নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছু মতভেদ থাকলেও অধিকাংশের মতে, তিনি কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়া গ্রামে বসবাস করতেন এবং সেখানেই তাঁর আখড়া প্রতিষ্ঠিত ছিল। লালন তরুণ বয়সে একবার কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থায় স্থানীয় এক মুসলমান ফকিরের সেবা ও আশ্রয়ে জীবনে নতুন আলো পান। এই ঘটনাই তাঁর চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলে, এবং পরবর্তীতে তিনি জাতপাত ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

লালন শাহ তাঁর দীর্ঘ সাধনাজীবনে অসংখ্য গান রচনা করেছেন, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা, ভেতরের ঈশ্বর-চেতনা, প্রেম, মানবতা ও মুক্তির দর্শন তুলে ধরেছেন। তাঁর গানে সুফি, বৈষ্ণব ও সহজিয়া দর্শনের সমন্বয় দেখা যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের ভেতরেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিরাজমান—তাকে খুঁজে পেতে হলে বাহ্যিক আচার নয়, প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি ও ভালোবাসা। লালনের গান যেমন দর্শনে গভীর, তেমনি সহজ-সরল ভাষায় গ্রামীণ বাংলার মানুষের হৃদয়ে গভীর ছোঁয়া দেয়। তাঁর বিখ্যাত কিছু গান হলো — “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”, “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে”, “আস্তে আস্তে শেখো রে ভাই”, “আমি একদিনও না দেখিলাম তারে” ইত্যাদি।

লালন শাহ জীবদ্দশায় কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি বা রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি এক শান্তিপ্রিয়, ভাবুক ও মুক্তচিন্তার সাধক হিসেবে সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেন। মৃত্যুর পর তাঁর আখড়াটি আজও কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় “লালন আখড়া” নামে তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থী ‘লালন ফকিরের দোল উৎসব’-এ যোগ দেন। লালনের ভাবধারা ও গান আজও বাঙালি সংস্কৃতি, লোকসংগীত ও মানবতাবাদী চিন্তাধারায় অমলিন ছাপ রেখে চলেছে।

0 CommentsClose Comments

Leave a comment

Newsletter Subscribe

Get the Latest Posts & Articles in Your Email

We Promise Not to Send Spam:)