ফেরেব ছেড়ে কররে ফকিরি ।
দিন তােমার হেলায় হেলায়
তুল, আখেরী ॥

ফেরের ফকিরের ধারা
দরগা নিশান ঝান্ডা গাড়া
গলায় বেঁধে হড়া মড়া
শিরনি খাওয়ার ফিকিরি ॥

আসল ফকিরি মতে
বাহ্য আলাপ নাহি তাতে
চলে শুদ্ধ সহজ পথে
গবােধের চটক ভারী ॥

নাম গােয়ালা কাজি ভক্ষণ
তােমার দেখি তেমনি লক্ষণ
সিরাজ সাঁই কয় অবােধ লালন
সাধুর হাটে কর চাতুরী ॥

.

.

ফকির লালন শাহ্‌ (১৭৭৪ – ১৭ অক্টোবর ১৮৯০) ছিলেন বাংলার একজন মহান মানবতাবাদী সাধক, বাউল, দার্শনিক, সমাজসংস্কারক ও গীতিকার। তাঁকে “বাউল সম্রাট” বলা হয়। তাঁর গান, দর্শন ও জীবনাচরণ বাঙালির লোকসংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা ও মানবতাবাদে গভীর প্রভাব ফেলেছে। নিচে তাঁর জীবনী বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো —


🌿 প্রারম্ভিক জীবন

লালন শাহের জন্মস্থান ও জাতিগত পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন, তিনি কুষ্টিয়া জেলার ঝিনাইদহের হারিশপুর বা লালন শাহের টাঁড় নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ধারণা করা হয়, তাঁর জন্ম ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে।
শৈশবে তিনি একবার তীর্থযাত্রায় গিয়ে গুরুতর গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। সঙ্গীরা তাঁকে মৃত ভেবে ফেলে যায়। পরে এক মুসলমান নারী তাঁকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলেন। এই ঘটনার পর থেকেই লালন জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন এবং মানবতাকে ধর্মের উপরে স্থান দেন।


🕊️ সাধনা ও দার্শনিক চিন্তা

লালন ফকির ছিলেন এক অনন্য সাধক। তিনি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে অনুসরণ করতেন না; বরং সকল ধর্মের সীমা অতিক্রম করে মানবধর্ম প্রচার করতেন।
তিনি বলতেন —

“সব লোকে কয় লালন কে জাত সংসারে,
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।”

তাঁর দর্শনের মূলকথা ছিল —

  • মানুষই প্রকৃত সাধনার কেন্দ্র।
  • ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ বা সম্পদ নয়, মানবতা ও প্রেমই সর্বোচ্চ সত্য
  • দেহতত্ত্ব ও মনতত্ত্বের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনই জীবনের লক্ষ্য।

🎵 গান ও সাহিত্যকর্ম

লালন শাহ প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন, যদিও সব সংরক্ষিত নেই। তাঁর গানগুলোতে দার্শনিক ভাব, মানবপ্রেম, সমাজচেতনা ও আত্মোপলব্ধির আহ্বান রয়েছে।
বিখ্যাত কিছু গান হলো —

  • “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”
  • “আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে”
  • “সব লোকে কয় লালন কে জাত সংসারে”
  • “আছো দয়াল দীনবন্ধু”

তাঁর গান আজও গ্রামীণ ও নগর জীবনে সমানভাবে জনপ্রিয়।


🕯️ মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

লালন শাহ ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তাঁর সমাধি (লালন আখড়াবাড়ি) আজও বাউলদের পবিত্র তীর্থস্থান।
প্রতি বছর লালন স্মরণোৎসব বা লালন মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দেশ-বিদেশের বাউল, গবেষক ও দর্শনার্থীরা একত্রিত হন।


উপসংহার

ফকির লালন শাহ ছিলেন ধর্ম ও সমাজের সীমা অতিক্রম করা এক মুক্ত আত্মা। তাঁর গান ও দর্শন বাঙালির চেতনায় মানবতা, ভালোবাসা ও সমতার বার্তা বহন করে চলছে যুগ যুগ ধরে।

0 CommentsClose Comments

Leave a comment

Newsletter Subscribe

Get the Latest Posts & Articles in Your Email

We Promise Not to Send Spam:)