ফানা ফিল্লায় মুসাহেদায় মশগুল রয়।
মুরাকেবায় দাখিল হলে
ইরফানি কোরান তার শুনায় ॥
আবির কুবির জানলে পরে
চার রং যায় আপনি সরে
শেষে আবার লাল রং ধরে
তারে কি হাতে ধরা যায় ॥
নফসের জ্যোতি আসলে পরে
বিজরীর চটক ঝরে
সেই নফছ সাধন না করে
তারে কি সাধক বলা যায় ॥
আদ্যরূপ পুরা নফছ জারি
সামাল হলে হয় ফকিরি
লালন বলে হায় কি করি
বল কোথা যাই ॥
।
।
🌿 ফকির লালন শাহ্ (১৭৭৪ – ১৮৯০)
পরিচয়
ফকির লালন শাহ্ (সাধারণভাবে লালন ফকির নামে পরিচিত) ছিলেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী সাধক, বাউল, দার্শনিক, কবি ও সমাজ সংস্কারক। তিনি ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি প্রথাগত বিভেদকে অস্বীকার করে মানবপ্রেমকে সর্বোচ্চ সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করেছিলেন।
জন্ম ও শৈশব
- লালনের জন্মস্থান ও জন্মতারিখ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
- অধিকাংশ গবেষক মনে করেন তিনি ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নদীয়া জেলার হারিশপুর বা কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
- জন্মসূত্রে তিনি হিন্দু (কেউ কেউ বলেন কৈবর্ত বা তেলি সম্প্রদায়ভুক্ত) ছিলেন, তবে পরবর্তীতে ধর্মের গণ্ডি অতিক্রম করে মানবধর্মে দীক্ষিত হন।
জীবনের মোড় পরিবর্তন
একবার তীর্থযাত্রা থেকে ফেরার পথে লালন গুরুতর বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন।
সহযাত্রীরা তাঁকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে যায়।
পরে এক মুসলমান ফকির দম্পতি তাঁকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলেন।
এই ঘটনার পর লালনের মনে ধর্মীয় বিভেদের প্রতি তীব্র বিরোধ ও মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জাগে।
তিনি সমাজের প্রচলিত হিন্দু–মুসলমান বিভাজনকে অস্বীকার করে নতুন জীবনধারায় প্রবেশ করেন।
সাধনা ও দর্শন
- তিনি বাউল দর্শন বা মানবধর্ম প্রচার করতেন।
- তাঁর দর্শনের মূল কথা — “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”
- তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্য ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান।
- জাত, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, মন্দির, মসজিদ—সব কিছুর উর্ধ্বে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ।
কর্ম ও অবদান
- লালন ছিলেন এক অসাধারণ গীতিকার ও সংগীতকার।
- ধারণা করা হয়, তিনি প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন, যেগুলোর অধিকাংশই মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়েছে।
- তাঁর গানগুলোতে রয়েছে গভীর দার্শনিক চিন্তা, মানবপ্রেম, আধ্যাত্মিক অন্বেষা এবং সমাজের ভণ্ডামির প্রতি প্রতিবাদ।
প্রসিদ্ধ কিছু গান:
- “আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে”
- “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”
- “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে”
- “পাগল বলো কে রে”
শিষ্য ও অনুসারী
- লালনের অসংখ্য শিষ্য ছিল, যাঁরা তাঁর দর্শনকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দেন।
- তাঁর অন্যতম শিষ্য ছিলেন পাঞ্জু শাহ, মনিরুদ্দিন শাহ, মধু শাহ প্রমুখ।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের ভাবধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
মৃত্যু
- ফকির লালন শাহ্ ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।
- সেখানে তাঁর সমাধিস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লালন আখড়া, যা আজও বাউল সাধক ও দর্শনার্থীদের তীর্থস্থান।
উত্তরাধিকার
লালন ফকির কেবল একজন বাউল নন—তিনি ছিলেন মানবতার কবি, অন্তর্দর্শনের দার্শনিক, এবং বাংলা সংস্কৃতির চেতনার প্রতীক।
তাঁর গান আজও বাংলার গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত মানুষকে ভাবায়, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়।
